ভূমি উন্নয়ন কর আইন-২০২১ প্রণয়ন করছে সরকার। কোনো জমি ভোগদখলের সুবিধা গ্রহণের জন্য সরকারকে প্রতি শতাংশ প্রতি বছরভিত্তিক যে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হয় সেটাই হচ্ছে ভূমি উন্নয়ন কর। ভূমি উন্নয়ন কর দেয়ার পর দাতা দাখিলা তথা মানিরিসিট পাবেন।
এই দাখিলা জমির মালিকানা প্রমাণের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে ব্যবহূত হবে। যা জমির নামজারি বা ক্রয় কিংবা বিক্রয়সহ নানান কাজে ব্যবহূত হচ্ছে। নতুন আইন অনুসারে প্রতি বছর ১ জুলাই থেকে পরবর্তী বছর ৩০ জুন সময়ের মধ্যে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু অনেকেরই ভূমি উন্নয়ন কর বকেয়া পড়ে থাকে।
সঠিক ধারণা না থাকায় অনেকেই ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করেন না। সেই ক্ষেত্রে প্রথম বছরের বকেয়ার জন্য ১০ দ্বিতীয় বছরের বকেয়ার জন্য ১৫ এবং তৃতীয় বছরের বকেয়ার জন্য ২০ শতাংশ হবে জরিমানা গুনতে হবে। তৃতীয় বছর শেষে সার্টিফিকেট মামলা করা হবে। ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করা হবে। এমনকি জমির মালিকানা হারাতে হতে পারে। এক্ষেত্রে একটি ভুল ধারণা রয়েছে তিন বছরের বেশি বকেয়া থাকলে তা আদায় করা যায় না। আসলে তা ঠিক নয়।
বিধিমালা এ বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছে। তবে তিন বছরের মধ্যেই আদায়ের জন্য রেন্ট সার্টিফিকেট মামলা করতে হয়। আবার কেউ চাইলে তিন বছরের ভূমি উন্নয়ন কর অগ্রিম পরিশোধ করতে পারবেন। এক সাথে তিন বছরের বেশি অগ্রিম পরিশোধ করা যাবে না।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেশে কিংবা বিদেশে বসেই ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা যাবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের তফসিলভূক্ত যেকোনো অনলাইন ব্যাংকের মাধ্যমে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা যাবে। ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের বেধে দেয়া হারে সার্ভিস চার্জ গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করতে পারবে।
ভূমি সহকারী কর্মকর্তা চালান, অনলাইনে কিংবা ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে আদায়ের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ করবেন। আদায় হওয়া অর্থ সরকার নির্ধারিত কোডে ব্যাংকে জমা দিতে হবে। ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে আদায় হওয়া অর্থের যাবতীয় রেকর্ডসমূহ সংরক্ষণের জন্য ইলেক্ট্রনিক রেজিস্টার খোলা হবে। যাতীয় তথ্য ওই রেজিস্টারে সংরক্ষণ করা হবে। বছর শেষে ওই রেজিস্টার মৌজাভিত্তিক বাঁধাই করে সংরক্ষণ করা হবে। দেশের যেকোনো জেলা কিংবা উপজেলাই জমি থাকুক একটি মাত্র হোল্ডিং খুলে সব জমির খানজা এক সাথে পরিশোধ করা যাবে।
সরকারি কবরস্থান, শ্মশান, জামে মসজিদ, ঈদগাহ মাঠ, সর্বজনীন মন্দির, গির্জা, অথবা সর্ব সাধারণের প্রার্থনার স্থানসমূহ ভূমি উন্নয়ন করের আওতামুক্ত থাকবে।ব্যক্তিগত, পারিবারিক, গোত্রীয়, দলীয় ও সম্প্রদায়ভিত্তিক উপাসনালয়, সমাধি ক্ষেত্র, দান ও দর্শনীর অর্থে অথবা সহায়ক বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালিত হলে তা ভূমি উন্নয়র কর দিতে হবে। পরপর তিন বছর কোনো ভূমি মালিক ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ না করলে ১৯১৩ সালের দ্য পাবলিক ডিমান্ড রিকোভারির বিধানের আলোকে তার বিরুদ্ধে মামলা করে জরিমানাসহ কর আদায় করা হবে।
এ মামলার মাধ্যমেই জমি নিলামে বিক্রি করা হয়। কোনো ক্রেতা পাওয়া না গেলে সরকার এক টাকা দিয়ে এ জমি কিনে খাস জমিতে পরিণত করে তা ভূমিহীনদের মধ্যে বন্দোবস্ত দিতে পারে। এ কারণে প্রতি বছরই ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা উচিত। তবে বকেয়া পড়ে গেলে যেই বছর হতে কর বকেয়া রয়েছে তা ওই বছরের হার অনুযায়ী আদায় করতে হবে। এক্ষেত্রে ৬.২৫ ভাগ সুদ জ্যামিতিক হারে যোগ হবে।
কৃষিজমি বাদে অন্যান্য সব জমিই অকৃষি কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত রাখলে তা অকৃষি জমি বলে গণ্য হবে। সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, বাজারের সব জমি অকৃষি জমি; তাতে কৃষিকাজ করা হলেও। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ মহানগরীর মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার আবাসিক জমির কর শতক প্রতি ৬০, বাণিজ্যিক ৩০০ টাকা এবং জেলা সদরের আবাসিক জমির কর শতক প্রতি ২০ টাকা, বাণিজ্যিক ৬০ টাকা এবং অন্যান্য সব পৌর এলাকার আবাসিক জমির জন্য কর শতক প্রতি ২০ টাকা বাণিজ্যিক হার ৬০ টাকা। পৌরসভা ঘোষিত হয়নি এরূপ এলাকার আবাসিক পাকা ভিটি হার ২০ টাকা, বাণিজ্যিক ৪০ টাকা।
শিল্প বা বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে শিল্প ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহূত ভূমির জন্য যে পরিমাণ জায়গা শিল্প-বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহূত হয় তার কর বাণিজ্যিক হারে হবে। আর যে পরিমাণ জমি আবাসিক কাজে ব্যবহূত হবে তার খাজনা আবাসিক হারে হবে। ২০১৫ সালের নতুন পরিপত্র অনুসারে অব্যবহূত বা পতিত জমির কর কৃষি হারে (এক টাকা প্রতি শতাংশ) হবে। তার আগের কর বাণিজ্যিক হারে হবে।
কৃষিজমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গবাদিপশু পালন ও হাঁস-মুরগির খামার স্থাপন করা হলে সেই জমির পরিমাণ যাই হোক বাণিজ্যিক হারে কর হবে। শহর, উপশহর, পৌরসভা ও উপজেলা সদরে অবস্থিত বসতবাড়ি সংলগ্ন অকৃষি জমিতে ডিম, দুধ ও মাংস উৎপাদনের লক্ষ্যে স্থাপিত খামারে দুগ্ধবতী গাভীর সংখ্যা অনধিক ১৫টি হলে এবং হাঁস-মুরগির সংখ্যা অনধিক ৫০০টি হলে ওই খামারের ভূমিকর আবাসিক হারে হবে। সরকারি-আধা সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা কর্তৃক গবেষণামূলক কাজের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত খামারের জমির খাজনা আবাসিক হারে আদায় করতে হবে। যেকোনো খামারে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দুধ ও মাংস প্রক্রিয়াজাত করে বিপণন বা বিক্রির ব্যবস্থা করলে ভূমিকর বাণিজ্যিক হারে হবে।
উল্লেখ্য, যে এসব খামারের গোচারণভূমি বা হাঁস-মুরগির খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহূত জমির কর আবাসিক হারে হবে। এ ছাড়া খেলার মাঠ, স্টেডিয়াম, সুইমিং পুল, শরীরচর্চা কেন্দ্র এবং সরকারি সব ক্রীড়া চত্বরের কর প্রতি শতাংশ দুই টাকা হারে হবে।
বর্তমানে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা বা তহশিলদার ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করে থাকেন। আগেই বলা হয়েছে— এরা কোনো অসৎ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য বেশি কর ধার্য করলে অথবা এতদসংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে সমস্যা সৃষ্টি হলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর সাথে যোগাযোগ করতে হবে। দাবি সম্পর্কে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক-রাজস্ব অথবা জেলা প্রশাসকের কাছে ১৫ দিনের মধ্যে আপত্তি দাখিল করতে হবে।
জেলা প্রশাসকের আদেশে কোনো ব্যক্তি সন্তুষ্ট না হলে সেই আদেশের বিরুদ্ধে ৪৫ দিনের মধ্যে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে আপিল করা যাবে। বিভাগীয় কমিশনারের আদেশে কোনো ব্যক্তি সন্তুষ্ট না হলে সেই আদেশের বিরুদ্ধেও ১৫ দিনের মধ্যে ভূমি আপিল বোর্ডের কাছে আপিল করা যাবে। বর্তমানে সরকার ভূমিসেবা আরো সহজ এবং হয়রানিমুক্ত করার জন্য নামজারির মতো অনলাইনেও ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে কাজ চলমান রয়েছে।
সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর জন্য যেমন ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের হার বাড়ানো দরকার তেমনি সাধারণ মানুষকে নিজের জমির মালিকানা এবং দখল নিশ্চিত করার জন্য স্বেচ্ছায় ভূমি উন্নয়ন কর দিতে আগ্রহী হতে হবে। এই আইন কার্যকরের সাথে সাথে দ্য ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট টেক্স অর্ডিনেন্স-১৯৭৬ বাতিল বলিয়া গণ্য হবে। আইনটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। যেকোনো সময় আইনটি অনুমোদন হতে পারে বলে জানা গেছে।
Leave a Reply